‘লেখক-প্রকাশকের বিশ্বাসের জায়গা তৈরি করেছিলেন মহিউদ্দীন’

Mar 16, 2024 - 12:07
 0  63
‘লেখক-প্রকাশকের বিশ্বাসের জায়গা তৈরি করেছিলেন মহিউদ্দীন’
ছবিঃ প্রতিনিধি/ওভি

ঢাকা, ১৫ মার্চ (বিশেষ প্রতিনিধি/আওয়ার ভয়েস) – লেখক ও প্রকাশকদের মধ্যে বিশ্বাসের জায়গা তৈরি করেছিলেন প্রয়াত প্রকাশক মহিউদ্দীনন আহমদ। লেখকদের গ্রন্থ বিক্রির সম্মানী দিতে বছর জুড়ে পাকা হিসাব করে রাখতেন। হিসেব লেখা থাকতো বাংলা বছরগুনে। বছরের শুরুতে পহেলা বৈশাখে লেখকদের পাওনা বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। আর এই সম্মান পাঠিয়েছেন হয় নিজে অথবা সন্তানদের মাধ্যমে। তাঁর কাছে প্রতারণা ছিল অপ্রত্যাশী।

মহিউদ্দীন আহমদের জ্যেষ্ঠ পুত্র অধ্যাপক ড. কামালউদ্দীন আহমদ এভাবেই প্রকাশক হিসেবে তাঁর বাবার বৈশিষ্ট্য বলছিলেন।

দেশের সৃজনশীল প্রকাশনার অন্যতম পথিকৃৎ মহিউদ্দীন আহমদ তাঁর প্রতিষ্ঠান আহমদ পাবলিশিং হাউসের মাধ্যমে সৃজনশীল সাহিত্য বিকাশে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করেছেন। মননশীল জাতি গঠনে তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য। মহান ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত সফলতায় এই প্রকাশকের ভূমিকা স্মরণীয়। মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধের ইতিহাস ভিত্তিক প্রকাশনায় গুরুত্ব দেন মহিউদ্দীন আহমদ। ২০২৪ সালের ১৫ মার্চ তাঁর ৩৪তম মৃত্যুবার্ষিকী।

অধ্যাপক ড. কামালউদ্দীন আহমদ বলেন, আমাদের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে যেসব লেখকদের বই প্রকাশিত হতো, তাঁদের রয়্যালটি বাবা কর্মচারীদের না দিয়ে, প্রায়শই আমাকে দিয়ে পাঠাতেন। পাশাপাশি বছরের শুরুতে গত বছর কার কত কপি বই বিক্রি হয়েছে, এ বিষয়ে যদি কারও কোন সন্দেহ থাকতো, তবে বাবা তাঁর লেজারের রক্ষিত বিস্তারিত হিসাব দেখিয়ে দিতেন।

কামালউদ্দীন বলেন, বাবার সমাজকে দেওয়ার মনোবৃত্তি ছিল। তিনি গ্রামমুখী ছিলেন, উন্নয়ন কাজেও যুক্ত ছিলেন। প্রকাশক হিসেবে সমাজ সেবায় অনেক কাজ করেছেন। একাধিক স্কুল, কলেজ, সড়ক, মাদ্রাসা, মসজিদ, পাঠাগার, ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠায় দান করেছেন।

মহিউদ্দীন আহমদ ১৯১৯ সালের জানুয়ারি মাসে কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার বিটেশ্বর গ্রামের এক ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম আলতাফউদ্দীন আহমদ ভূঁইয়া এবং মাতা মরহুম মোসাম্মৎ আসিয়া খাতুন। ১৯৮৪ সালে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র তাঁর সৃজনশীল কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ 'জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র স্বর্ণপদক' এবং ১৯৮৬ সালে একুশে বইমেলায় বাংলা একাডেমী তাঁকে 'বাংলা একাডেমী সম্মাননা' প্রদান করে।

মহিউদ্দীন আহমদ ব্যক্তিগত জীবনে সদালাপী, মানবতাবাদী এবং একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর ব্যক্তি জীবনের প্রভাব তাঁর পারিবারিক জীবনেও পড়েছে। নিজের সন্তানদের তিনি নিজের আদর্শেই গড়ে তুলেছেন। সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে দুই ছেলে এবং ছয় মেয়ে। তিনি ১৯৯০ সালের ১৫ মার্চ পরলোকগমন করেন।

২০১১ সালে প্রকাশক মহিউদ্দীন আহমদের স্মৃতি এবং সৃজনশীল কর্মকে ধরে রাখার জন্য আলোকিত মানুষ মহিউদ্দিন আহমদনামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছে আহমদ পাবলিশিং হাউস। যেখানে মহিউদ্দিন আহমদকে দেখা দেশের সনামধন্য অনেক লেখকের লেখা গ্রন্থটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

গ্রন্থটিতে এক সহৃদয় মানুষের কথা শিরোনামে জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন, মহিউদ্দীন সাহেবের চরিত্রে লুকোচুরির কোন ব্যাপার ছিল না, তাঁর আগ্রহ ছিলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সকলের গোচরে আনা।

কর্মবীর মহিউদ্দীন আহমদশিরোনামে দেশের প্রথম নজরুল গবেষক ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, গ্রন্থপ্রেমিক ছিলেন তাই গ্রন্থ প্রকাশ ছিল তাঁর পেশা। গ্রন্থের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য রূপে সম্পৃক্ত শিক্ষার প্রতি ছিল গভীর আগ্রহ। শিক্ষা বিস্তারে তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। যা সচরাচর দেখা যায় না। এই যোগসূত্রের কারণেই তিনি আমাদের কাছে স্মরণীয়।

বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক কবি আশরাফ সিদ্দিকী পথিকৃৎ প্রকাশক মহিউদ্দিন আহমদশিরোনামে বলেছেন, মুসলমান পাঠকদের জন্য ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বিষয়ে যে সব গ্রন্থ, বই বা শিশু সাহিত্য উপযোগী হতে পারে সেদিকেই ছিল তাঁর লক্ষ্য। ব্যবসার দিকটা তিনি খুব একটা দেখতেন না।

কবি মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ একজন সাহিত্য প্রেমী প্রকাশক মহিউদ্দিন আহমদশিরোনামে বলেছেন, প্রবীণ ও প্রতিষ্ঠিত লেখকদের গ্রন্থটি প্রকাশের পাশাপাশি আধুনিক ও সমকালীন নবীন প্রবীন লেখকদের বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থাদি প্রকাশের পরামর্শ অত্যন্ত আন্তরিকতা এবং সুবিবেচনার সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন। 

বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক মাহমুদ শাহ কোরেশী পথিকৃৎ প্রকাশকশিরোনামে বলেছেন, ১৯৫৬ সালে তিনি যখন প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তখন এই ব্যবসা খুবই নড়বড়ে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে ধাবমান পথিকৃৎ প্রকাশক মহিউদ্দিন সাহেব বইপুস্তক এবং তৎসহ মানচিত্র, ম্যাপ, চার্ট ইত্যাদিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে প্রভূত উন্নয়ন সাধন করলেন। এই সাফল্য অর্জনে সহায়ক ছিলেন তাঁর দেশপ্রেম এবং অনিঃশেষ সততা। পাশাপাশি উন্নত রুচিবোধ তাঁকে বিষয় ও লেখক নির্বাচনে সহায়তা দিয়েছে।

একজন নিবেদিতপ্রাণ প্রকাশকশিরোনামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রয়াত অধ্যাপক ড. রশীদ আল ফারুকী বলেছেন, জনাব মহিউদ্দীন একজন সরল ও অমায়িক প্রকৃতির লোক-যা তাঁর জীবনের সর্বত্র পরিব্যপ্ত। দেশের প্রকাশনা শিল্পের যে হাল তাতে তাঁকে বড় ব্যবসায়ী বলা যায়। কিন্তু বড় ব্যবসায়ীসুলভ কোন অহমিকা তাঁর মধ্যে নেই তেমনি নেই কোন অসততা। যে কারণে প্রতিটি লেখক তাঁর ওপর প্রসন্ননির্ভর। 

সাহিত্য গবেষক মুহাম্মদ মীজানুর রহমান প্রকাশনা ভুবনে মহিউদ্দীন আহমদশিরোনামে বলেছেন, দেশের পুস্তক প্রকাশনা শিল্পের অন্যতম অগ্রদূত হচ্ছেন মহিউদ্দীন আহমদ। আজীবন অকৃত্রিম অধ্যবসায়, কঠোর শ্রম ও নিষ্ঠা এবং সর্বোপরি সততার সঙ্গে বাংলাদেশে তিনি একটি উন্নতমানের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন।

এক সফল প্রকাশকের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলিশিরোনামে বিশিষ্ট পুস্তক সমালোচক বদিউদ্দীন নাজির বলেছেন, বাঙালি মুসলমান ছিলেন এবং গর্বের সঙ্গে ঐ পরিচয়ই বজায় রেখেছিলেন। তাঁর প্রকাশনা কার্যক্রমেও সেই পরিচয়টিই প্রধান হয়ে রয়েছে।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow

News Desk Chief Editor, Our Voice Online