কম কীটনাশকে অধিক বেগুন উৎপাদন, বাড়বে লাভ

Mar 1, 2025 - 01:53
 0  8
কম কীটনাশকে অধিক বেগুন উৎপাদন, বাড়বে লাভ
ছবিঃ প্রতিনিধি/ওভি

ময়মনসিংহ, ফেব্রুয়ারি (বাকৃবি প্রতিনিধি/আওয়ার ভয়েস) বাংলাদেশের মানুষের কাছে বেগুন একটি প্রিয় খাদ্য হিসেবে পরিচিত। বেগুন একদিকে যেমন পুষ্টিকর খাবার, অন্যদিকে এটি সঠিক পদ্ধতিতে চাষ করে সহজেই লাভবান হওয়া যায়। চাইলে বছর ব্যাপী এটি চাষ করা যায়।

বাংলাদেশে আলুর পরেই দ্বিতীয় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সবজি হল বেগুন। বিবিএস, ২০১৮ এর তথ্য মতে, এটি প্রায় ১২.৫৭ শতাংশ সবজি চাষের জমিতে চাষ হয় এবং এর উৎপাদন প্রতি হেক্টরে ১০.০৮ টন (২০১৭-১৮)এই সম্ভাবনাময় বেগুনের চাষ করতে গিয়ে চাষীরা বেশ কিছু ক্ষতিকর পোকার আক্রমণে পড়েন। বেগুন চাষকালীন সময়ে ৩৬টিরও বেশি পোকামাকড় এটি আক্রান্ত করে, যার মধ্যে সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক হলো ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার (Leucinodes orbonalis) আক্রমণ।
বাংলাদেশের কৃষকরা সাধারণত বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা দমনের জন্য প্রতি সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার, এমনকি দিনে দুইবারও কীটনাশক প্রয়োগ করেন। এতো বেশি কীটনাশক ব্যবহার করা সত্ত্বেও কৃষকরা বেগুনে ৩০-৬০ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতির শিকার হন। ফলে তারা আরও বেশি কীটনাশক প্রয়োগ করেন, যা এক মৌসুমে ১০০ বারেরও বেশি স্প্রে করা পর্যন্ত গড়ায়। এতে বেগুনের ওপর উচ্চমাত্রার কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ থেকে যায়, যা স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। পুরো বেগুন চাষের খরচের ৩৫-৪০ ভাগ শুধুমাত্র কীটনাশক ও এর প্রয়োগের পেছনে ব্যয় হয়। এই অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হওয়ার পাশাপাশি কীটের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলছে এবং এর ফলে নতুন কীট সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। তাই এর সমাধানে পরিবেশবান্ধব বিকল্প পদ্ধতির প্রয়োজন। এই লক্ষ্যেই মেটিং ডিসরাপশন প্রযুক্তির কার্যকারিতা পরীক্ষা করে সাফল্য পেয়েছেন ইউনাইটেড স্টেটস এইড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (ইউএসএআইডি) আইপিএম অ্যাক্টিভিটি ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক।
গবেষণার বিষয়ে কথা বললে এসব তথ্য জানান গবেষক দলের সদস্য কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ। ভার্জিনিয়া টেকের আইপিএম ল্যাবের পরিচালক ড. রাঙ্গাস্বামী মুনিয়াপ্পান গবেষণাটি পর্যবেক্ষণ করেন বলেও জানান তিনি।
তিনি জানান, বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার স্ত্রী পোকা পাতার নিচে, ডালপালা ও ফুলের উপর ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে বের হওয়া লার্ভা গাছের নরম অংশে ঢুকে সংরক্ষিত টিস্যু খেয়ে ফেলে, ফলে গাছের উপরের অংশ শুকিয়ে মারা যায়। গাছে ফল আসলে এরা ফলে আক্রমন করে ও ফলের অভ্যন্তরীণ অংশ খেয়ে এটি নষ্ট করে, যা বাজারজাতকরণ ও ভোক্তার ব্যবহারের জন্য অনুপযুক্ত করে তোলে। বাংলাদেশে এ পোকার কারণে ফলনের ক্ষতি ৮৬ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ভার্জিনিয়া টেক ও ইউএসএআইডি-এর আর্থিক সহায়তায় ফিড দ্যা ফিউচার মিশনের ইন্টিগ্রেটেড পেস্ট ম্যানেজমেন্ট এক্টিভিটি এটি বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়। এই প্রকল্পের প্রধান লক্ষ্য ছিলো বাংলাদেশের কৃষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, যেন তারা সম্মিলিতভাবে পরিবেশ সম্মতভাবে ফসলের বর্তমান এবং উদ্ভূত হুমকির নিয়ন্ত্রণ ও বিস্তার রোধ করতে পারে। এই প্রকল্প বেগুনসহ ১৩টি ফসলের সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন করে।

তিনি আরও জানান, ২০২৩ সালে আইপিএম অ্যাক্টিভিটি ও ভার্জিনিয়া টেক যৌথভাবে ঢাকায় একটি কর্মশালার আয়োজন করে। সেই ধারাবাহিকতায় এই প্রকল্পে এটিজিসি, ইস্পাহানী বায়োটেক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) সহযোগিতায় একটি গবেষণা কার্যক্রম বাস্তবায়িত করা হয়। মাগুরা, ঝিনাইদহে এবং বাকৃবিতে অবস্থিত জমিতে এ গবেষণা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়।
সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার বিষয়ে তিনি বলেন, সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে ফেরোমন। কারণ এটি রাসায়নিক বালাইনাশকের উপর নির্ভরশীল না থেকে ক্ষতিকর পোকামাকড়কে মোকাবেলা করে। ফেরোমন হলো এক শ্রেণীর সেমিওকেমিক্যাল উপাদান। যা পোকামাকড় ও অন্যান্য প্রাণীরা তার নিজ প্রজাতির সাথে যোগাযোগ করতে ব্যবহার করে। এতে ওই পোকামাকড় বিপরীত লিঙ্গের পোকামাকড় ও তার স্বজাতির পোকাদের মধ্যে একটি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
নতুন প্রযুক্তির বিষয়ে তিনি জানান, মেটিং ডিসরাপশন হলো কীট দমন প্রযুক্তির একটি কৌশল, যেখানে কৃত্রিম উদ্দীপনার মাধ্যমে পোকাদের বিভ্রান্ত করা হয় এবং তাদের সঙ্গী সন্ধান ও প্রজনন প্রক্রিয়া ব্যাহত করা হয়। এতে তাদের বংশবিস্তার বন্ধ হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে কীটের সংখ্যা কমে আসে। বেগুনের জমিতে চারা রোপণের সাত দিনের মধ্যে প্রথমবার এই মেটিং ডিসরাপসশন জেল প্রয়োগ করা হয়। যখন ছোট থাকে তখন কাঠের মাথায় এবং যখন বড় হয়ে যায় তখন প্রতি মাসে একবার গাছের ডগায় প্রয়োগ করা হয়। যেহেতু বেগুন সারি সারি রোপন করা হয় তাই প্রতি এক সারি অন্তর যেমন এক, চা, সাত এভাবে প্রতি সারিতে মেটিং ডিসরাপশন জেল প্রয়োগ করা হয়েছে। একইভাবে পরের মাসে দুই, পাঁচ এবং আট এভাবে সমান দূরত্বে মেটিং ডিসরাপশন জেল প্রয়োগ করা হয়েছে। এভাবে পরের মাসেও প্রয়োগ করা হয়েছে।
বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার পাশাপাশি আরো বেশ কিছু পোকা যেমন সাদা মাছি, জাব পোকা সহ ইত্যাদি পোকার মাধ্যমে বেগুন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসকল পোকা দমন এবং রোগ ব্যবস্থাপনায় জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করা হয়েছে। এই গবেষণায় কোয়াড্রেট পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রতিটি বর্গক্ষেত্রের সবগুলো বেগুন গাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। নির্দিষ্ট সময় পর বেগুনগুলো ভোক্তার গ্রহনের উপযুক্ত হলে সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত বেগুন ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে মান অনুযায়ী বাছাই করা হয়। ট্রিটমেন্ট (যেটায় মেটিং ডিসরাপশন ব্যবহার করা হয়েছে) এবং কন্ট্রোল (রাসায়নিক কীটনাশক) জমি থেকে এই উপাত্তগুলো সংগ্রহ করা হয়।

গবেষণার ফলাফল নিয়ে তিনি জানান, ময়মনসিংহ, মাগুরা এবং ঝিনাইদহের ডিসেম্বর ২০২৩ থেকে জুন ২০২৪ পর্যন্ত বিভিন্ন মাসে মেটিং ডিসরাপশন প্রয়োগ করা জমিতে ধরা পড়া পোকার সংখ্যা ট্রিটমেন্ট জমি থেকে কম। অন্যদিকে ময়মনসিংহে বিভিন্ন মাসে বেগুনের ক্ষেতে ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমনের শতকরা হার কন্ট্রোল জমি থেকে মেটিং ডিসরাপশন ব্যবহার করা জমিতে তুলনামূলক কম। আবার মাগুরা ও ঝিনাইদহে ডিসেম্বর ২০২৩ থেকে জুন ২০২৪ পর্যন্ত জমিতে পোকা আক্রমণের শতকরা মেটিং ডিসরাপশন ব্যবহার করা জমি থেকে কন্ট্রোল জমিতে তুলনামূলক বেশি। কিন্তু পরবর্তীতে মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ট্রিটমেন্ট ও নিয়ন্ত্রিত জমিতে একই রকম ফলাফল পাওয়া গেছে। এক্ষেত্রে তাপমাত্রা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
আমরা যদি রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক চিন্তা করি ও খরচ চিন্তা করি তাহলে মেটিং ডিসরাপশন পদ্ধতি ব্যাবহার করে বেগুন চাষ করা লাভজনক। সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিতে বেগুন চাষে একদিকে যেমন লাভবান হবে কৃষক অন্যদিকে রাসায়নিকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকবে আমাদের স্বাস্থ্য, কৃষি জমি ও পরিবেশ বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow

News Desk Chief Editor, Our Voice Online