মহানন্দা নদীতে রাবার ড্যাম, নদী পাড়ের বাসিন্দাদের প্রতিক্রিয়া

মুসা মিয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি
দেশের সবচেয়ে বড় রাবার ড্যাম নির্মাণ করা হয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জে মহানন্দা নদীতে। এনিয়ে নদীর পাড়ের বাসিন্দাদের মাঝে দেখা গেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
ভারত থেকে প্রবেশ করে পদ্মা নদীর সঙ্গে সংযোগ হওয়া মহানন্দা নদীতে জেলা শহরের রেহাইচর এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছে রাবার ড্যাম। ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রভাব দেশে অনেক নদীর উপর পড়ছে। এর মধ্যে পদ্মা নদী অন্যতম। ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবের কারণে পদ্মা নদীর সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে প্রায় মৃত্যুর পথে। আর এই প্রভাব কাটিয়ে উঠতে মহানন্দা নদীতে নির্মাণ করা হয়েছে রাবার ড্যাম। চলতি মৌসুমে রাবার ড্যাম ফুলিয়ে আটকে রাখা হয়েছে পানি। এর ফলে রাবার ড্যামের উজানে পানি থাকলেও ভাটি অঞ্চল পানিশূন্য হয়ে গেছে। রাবার ড্যামের উজানে ৭০ কিলোমিটার এলাকায় স্বস্তি ফিরলে ভাটির ২৬ কিলোমিটার এলাকায় পড়েছে পানিশূন্যতার প্রভাব। রাবার ড্যামের উজান ও ভাটি অঞ্চলে নদী কেন্দ্রিক জীবনযাপন করে এমন অনেকের সঙ্গে কথা হয়। উজানের মানুষ স্বস্তি প্রকাশ করছেন এবং ভাটি অঞ্চলের মানুষ পানিশূন্যতার কারণে বিভিন্ন সমস্যার অভিযোগ করেছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, নতুন প্রকল্প গ্রহণ করে ভাটি অঞ্চলে পদ্মার পানি ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
উজানের মানুষদের প্রতিক্রিয়া:
মহানন্দা নদীর দুই ধারে হাজার হাজার হেক্টর জমিতে ফসলের চাষাবাদ হয়। নদী পাড়ের হাজার হাজার মানুষ নদী কেন্দ্রিক জীবনযাপন করে। কয়েক বছর থেকে পানিশূন্য হয়ে যাওয়ার কারণে বিরূপ প্রভাব পড়ে কৃষি ও মৎস্য উৎপাদনে। নদীর কোথাও হাঁটু পানি আবার কোথাও ছিল ধু ধু চর। এবার রাবার ড্যাম দিয়ে পানি আটকিয়ে রাখার কারণে নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, তাদের সেচ কাজে পানি ব্যবহার ও দৈনন্দিন কাজের পানির চাহিদা পূরন হচ্ছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার হরিনগর, ঘুঘুডিমা এলাকার বাসিন্দা আবু তালিব বলেন, কয়েক বছর থেকে নদীর পানি কমে যাচ্ছিল। জমিতে সেচ দেওয়া জন্য নদীর তলা থেকে পানি সেচ করতে হতো। রাবার ড্যামে আটকে দেওয়ার জন্য এবছর পানি ভালো রয়েছে। অন্যান্য বছর দুই তিন ঘণ্টায় যতটুকু পানি মেশিনে সেচ দেওয়া যেত এবছর এক ঘণ্টায় হয়ে যাচ্ছে। জমিতে পানি দিতে এজন্য খরচ কম হয়েছে এবার।
মল্লিকপুর এলাকার বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম বলেন, গত বছরে এখান দিয়ে মানুষ হেটে নদী পারাপার হয়েছিল। এতে নদী ঘিরে যারা জীবনযাপন করে তাদের পেশায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। নদীর বুক জুড়ে বিভিন্ন ফসল চাষাবাদ হয়েছিল। তবে এবার নদীতে পানি আছে। জেলেরা মাছ আহরণ করছে। কৃষি জমিতে সহজে সেচ দিতে পারছি। এমনভাবে সারা বছর পানি থাকলে আমরা উপকৃত হব। নদীর পাড়ের বাসিন্দারা লাভবান হবে।
ভাটি অঞ্চলের মানুষদের প্রতিক্রিয়া:
উজানে স্বস্তি পাওয়া গেলেও ভাটি অঞ্চলে পড়েছে পানিশূন্যতার প্রভাব। এই অঞ্চলের মানুষের পেশায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অনেকে অভিযোগ করছেন রাবার ড্যাম করে এই অঞ্চলে ২৬ কিলোমিটার নদী মেরে ফেলা হয়েছে। কৃষি জমিতে সেচ দিতে না পারা, পানি সংকটের কারণে মাছ না হওয়া সহ বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে জীববৈচিত্র্যের ওপর।
বারঘরিয়া গ্রামে অর্ধশত বছর ধরে আব্দুল রহিম মাছ ধরার পেশা নিয়োজিত। জীবনের বেশি সময় কাটিয়েছেন মহানন্দায়। তিনি বলেন, নদীতে পানি প্রবাহ নেই। তেমন মাছ পাচ্ছি না। আমি জীবনে এমনভাবে নদী শুকিয়ে যেতে দেখিনি।
দেবিনগর গ্রামের আব্দুর মতিন কয়েক যুগ থেকে নতুন ব্রীজ এলাকায় নদীর তীরে জমি চাষাবাদ করেন। তবে এবারের মতো পানিশূন্যতা কখনও দেখেননি। নদীতে পানি প্রবাহ নেই, তাই সেচ দিতে কয়েকগুণ বেশি খরচ হয়েছে তার। নদী হত্যা করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনিও। যে কোন উপায়ে নদীর পানি প্রবাহ বাড়ানোর অনুরোধ জানান তিনি।
বিশ্লেষকদের মতামত:
বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি মোঃ রবিউল আলম বলেন, সেচকাজে ভূগর্ভস্থ ও ভূউপরিস্থ পানির পরিমিত ব্যবহার না হওয়ায় অর্থাৎ অতিরিক্ত পানি ব্যবহারের ফলে দিন দিন চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্থানভেদে নিম্নগামী হচ্ছে। এ নিম্নগামিতা রোধকল্পে প্রবাহমান মহানন্দা নদীতে রাবার ড্যাম নির্মাণ করা হয়। এর ফলে রাবার ড্যামের উজানের পানি সেচের মাধ্যমে সেচ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে, যা কৃষক পর্যায়ে সমাদৃত হয়েছে। এ রাবার ড্যাম নির্মাণের ফলে একদিকে সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়েছে। অপরদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ভুগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমানো সম্ভব হয়েছে। এ রাবার ড্যামের কারণে উজানে পানির স্তর বৃদ্ধি পেলেও ভাটিতে পানির স্তর ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে। এর ফলে ভাটি অঞ্চলের সেচ কাজে যাতে কোন সমস্যা না হয়, সেটা এখন থেকে না ভাবলে ভবিষ্যতে এ রাবার ড্যামের কার্যকারিতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিবে। তাই উজান এবং ভাটি অঞ্চলের সেচ কাজের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে এখনি গবেষণা করে পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম আহসান হাবীব বলেন, রাবার ড্যাম নির্মাণের ফলে মহানন্দা নদীর উজানে অন্যান্য বছরের তুলনায় ৫ থেকে ৬ ফিট পানি বেশি আছে। এই পানি কৃষিকাজ ও বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। আগের বছর অনেক গভীর নলকূপে পানি পাওয়া যেত না, এবছর গভীর নলকূপে পানি পাওয়া যাচ্ছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এই অঞ্চলের কৃষিতে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। অন্যদিকে ভাটি অঞ্চল বিষয়ে তিনি বলেন, প্রত্যেকটা প্রকল্পেরই মেরিটস-ডিমেরিটস থাকে। পদ্মা নদীর পানি ব্যাক ওয়াটার ফ্লো দিয়ে মহানন্দা নদীতে সংরক্ষণ করা জন্য একটা প্রজেক্ট নেওয়া হবে। নদী খনন করে পানি প্রবাহ যেন ধরে রাখা যায়।
What's Your Reaction?






