নারিকেল গাছে সাদামাছির আক্রমণ: শণাক্ত নতুন প্রজাতি

Dec 25, 2024 - 05:40
 0  5
নারিকেল গাছে সাদামাছির আক্রমণ: শণাক্ত নতুন প্রজাতি
ছবিঃ প্রতিনিধি/ওভি

ময়মনসিংহ, ২৪ ডিসেম্বর (বাকৃবি প্রতিনিধি/আওয়ার ভয়েস) বাংলাদেশে নারিকেল গাছে সাদামাছির আক্রমণ কৃষকদের কাছে এক আতঙ্কের নাম। হোয়াইট ফ্লাই বা সাদা মাছির আক্রমণে নারিকেল গাছের ফলন হ্রাস এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। সাদা মাছির এরকম আরো একটি নতুন প্রজাতি শনাক্ত করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক।

সম্প্রতি গবেষণা দলের সদস্যরা সাদামাছির বিভিন্ন প্রজাতি শনাক্ত করার উদ্দেশ্যে  যশোর, খুলনা এবং বাগেরহাটে গেলে সেখানে একটি নতুন প্রজাতির উপস্থিতি লক্ষ্য করেন। পরে গবেষণাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণের পরে নতুন প্রজাতিটি শনাক্ত করা হয়। এই নতুন প্রজাতির সাদা মাছির বৈজ্ঞানিক নাম হল প্যারালেইরোডেস বোন্দারি এবং বাংলায় বলা হয় বোন্দার নেস্টিং সাদামাছি। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাকৃবির কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. গোপাল দাস।

তিনি 'রুগোজ স্পাইরালিং হোয়াইটফ্লাই এর বায়ো-ইকোলজি এবং মরফো-মলিকুলার অধ্যয়ন এবং গবেষণাগারে এই পোকার বিরুদ্ধে কিছু নতুন জেনারেশনের কীটনাশকের কার্যকারিতা মূল্যায়ন' শীর্ষক প্রকল্পের প্রধান গবেষক হিসেবে কাজ করছেন। কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের (কেজিএফ) অর্থায়নে ২০২৩ সালের মে মাস থেকে এই পোকাটির বিভিন্ন বিষয়ের উপর গবেষণা করছেন ড. গোপাল। তাঁর গবেষণা সহকারী হিসেবে রয়েছেন স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী মো. সোহেল রানা।

গবেষক ড. গোপাল দাস বলেন, দেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল নারিকেল। এক সময় গ্রামাঞ্চলে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই কম-বেশি নারিকেল গাছ ছিল। এর ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন জেলায় গড়ে উঠেছিল অনেক ছোটখাট শিল্প। তবে সম্প্রতি নারিকেল উৎপাদনকারী এবং ব্যবসায়ীদের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ, মরছে গাছ, কমছে ফলন। বহু মানুষের জীবিকা নির্বাহ এই নারিকেল শিল্পের সাথে জড়িত। বিভিন্ন কারণে দিন দিন নারিকেলের ফলন কমছে। রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ অন্যতম।

রুগোস স্পাইরালিং হোয়াইটফ্লাই  (বৈজ্ঞানিক নাম: আলিউরিডিকাস  রুজিওপারকিউলেটাস) যা নারিকেলের সাদা মাছি নামে পরিচিত। এই পোকাটি বাংলাদেশের নারিকেল শিল্পে একরকম বিপর্যয় ঘটিয়েছে। নারিকেল চাষীদের সর্বনাশকারী এই সাদা মাছি। ২০১৯ সালে বারির কীটতত্ববিদগণ বাংলাদেশে এর উপস্থিতি শনাক্ত করেন। দেশব্যাপী জরিপের মাধ্যমে এই পোকার ৬১টি পোষক উদ্ভিদ শনাক্ত করা হয়েছে, যা আমেরিকার একটি জার্নালে ২০২৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে এই পোকার বায়ো-ইকোলজি, প্রজাতি সনাক্তকরণ এবং এর ওপর বিভিন্ন জৈব-বালাইনশাকের কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে। প্রজাতি সনাক্তকরণের জন্য দেশের ৩০টি এগ্রো-ইকোলজিক্যাল জোন থেকে সাদামাছি সংগ্রহ করা হচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় যশোর, খুলনা এবং বাগেরহাটের নারিকেল গাছ থেকে সাদামাছি সংগ্রহ করে গবেষণাগারে আনা হয়। পরবর্তীতে এই সাদা মাছিগুলির মর্ফোলজিক্যাল বা বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য গবেষণাগারে অধ্যয়ন করা হয় এবং সেখানে কিছু ভিন্ন প্রজাতির সাদামাছির উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়। 

নতুন প্রজাতির মাছির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে গবেষক জানান, নতুন প্রজাতির সাদামাছি আকারে খুব ছোট এবং নারিকেলের সাদা মাছির প্রায় অর্ধেক (১ দশমিক ১-১ দশমিক ২ মিলিমিটার লম্বা)। এই পোকাটির সামনের পাখায় ক্রস-চিহ্নযুক্ত ধূসর বর্ণের ব্যান্ড রয়েছে। অন্য সাদা মাছি স্পাইরাল আকারে ডিম পারে, তবে এটি মোম ও তুলা  দিয়ে পাখির মত বাসা তৈরী করে সেখানে ডিম পাড়ে। এদের ডিমে পাতার বোটার মতো থাকে যা অন্য  সাদামাছিতে দেখা যায় না। এদের পিউপেরিয়াম সমতল এবং কোন লেজের মতো প্রজেকশন থাকে না। বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে সনাক্ত করা হলেও মলিকুলার অধ্যয়নের কাজ চলমান রয়েছে। অন্যান্য যেসব এগ্রো-ইকোলোজিক্যাল জোন থেকে সাদামাছি সংগ্রহ করা হয়েছিল সেখানে এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি। 

নতুন প্রজাতির মাছি হুমকির কারণ হওয়ার বিষয়ে ড. গোপাল দাস বলেন, ২০১৮ সালে ভারতের কেরালায় এবং ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে এই মাছি শনাক্ত করা হয়। পরে ২০২৪ সালের প্রথম দিকে শ্রীলঙ্কায়ও এই মাছির উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়। তবে বোন্দার নেস্টিং সাদামাছির পোষক উদ্ভিদ, বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় এটির আক্রমণের তীব্রতা এবং ক্ষতির মাত্রা কেমন সেসব বিষয়ে বিশদ গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। ভারত ও শ্রীলংকার কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, এই নতুন পোকাটির ডিম পাড়ার সময়কাল ও প্রজনন সক্ষমতা নারিকেলের সাদামাছির থেকেও বেশি। গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে নারিকেলের সাদামাছির সংখ্যা কমে গিয়ে বোন্দার নেস্টিং সাদামাছির সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছে। বাংলাদেশের জলবায়ুর ধরণ মোটামুটি ভারতের মতো হওয়ায় বাংলাদেশেও এই পোকাটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং নারিকেলের উৎপাদন আরো হুমকির মুখে পড়তে পারে। 

বিষয়টি নিয়ে অধিকতর গবেষণার বিষয়ে অধ্যাপক গোপাল দাস বলেন, এই নতুন পোকাটির ক্ষতির ধরণ নারিকেলের সাদামাছির মতোই তবে ক্ষতির ভয়াবহতা কেমন সেটি জানতে হলে এর বায়োলজি, প্রজনন সক্ষমতা, বৃদ্ধির হার ইত্যাদি নিয়ে গভীরতর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। তিনি আরো বলেন, নির্বিচারে কীটনাশক প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে এবং এর উপকারী পোকাসমূহকে প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow

News Desk Chief Editor, Our Voice Online