অর্থাভাবে চিকিৎসা ব্যাহত বাংলাদেশী তিন বৃক্ষ-মানব ও মানবীর 

Feb 26, 2024 - 12:26
Feb 26, 2024 - 12:28
 0  79
অর্থাভাবে চিকিৎসা ব্যাহত বাংলাদেশী তিন বৃক্ষ-মানব ও মানবীর 
Photo: ah/ov

ডঃ হোসাইন আব্দুল হাই, এনপিএফ (ইউএসএ) ফেলো

আবুল বাজানদার ও রিপন দাস নামে দুই জন পুরুষ এবং শাহানা খাতুন নামের এক মেয়ে ট্রি ম্যানসিনড্রোম নামে পরিচিত অত্যন্ত বিরল জেনেটিক রোগে ভুগছেন। আওয়ার ভয়েস এর বিশেষ গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে স্বাস্থ্য বীমার সুযোগ না থাকা, অপারেশনের আগে ও পরে পর্যাপ্ত কাউন্সেলিং না থাকা এবং চরম দারিদ্র্যের কষাঘাতে তারা যথাযথ চিকিৎসা ও অপারেশন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন

বাংলাদেশের প্রথম বৃক্ষমানব আবুল বাজানদার

আবুল বাজানদার তাদের মধ্যে একজন, যিনি তার হাত ও পায়ে গজানো গাছের শেকড়ের মতো ক্ষতগুলি অপসারণের জন্য বেশ কয়েকটি জটিল অপারেশন করেছেন। এই অবস্থাটি দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় ত্রুটির কারণে ঘটে যা হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের সংবেদনশীলতা বাড়ায় এছাড়া প্রায়ই দীর্ঘস্থায়ী এইচপিভি সংক্রমণ, ত্বকের ক্ষত এবং মেলানোমা স্কিন ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। এটি এত বিরল যে সারা বিশ্বে মাত্র পাঁচশ জনের দেহে ধরা পড়েছে

আবুল বাজানদার বাংলাদেশের প্রথম রোগী, যিনি তার জেনেটিক রোগ এপিডার্মোডিসপ্লাসিয়া ভেরুসিফর্মিস এর জন্য একাধিক অপারেশন করেছেন। একই ট্রি-মেন সিনড্রোমের আরও দুইজন রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেনতবে রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলা থেকে এ ধরনের বিরল জেনেটিক রোগের আরও একজন রোগী আমাদের হাসপাতালে এসেছেন। অবশ্য তিনি বিনা চিকিৎসায় হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যান এবং এখনও চিকিৎসা সুবিধার বাইরেই রয়ে গেছেন"বলে প্রতিবেদকের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রী এবং শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি এবং বাংলাদেশের সকল বার্ন ইউনিটের জাতীয় সমন্বয়ক ডঃ সামন্ত লাল সেন

ডঃ সামন্ত লাল সেন     ছবি-এএইচ/ওভি

১৯৮৮ সালে খুলনায় জন্মগ্রহণকারী আবুল বাজানদার ১৩ বছর বয়সে প্রথম গাছের শেকড়ের মতো ক্ষত লক্ষ্য করেন। তারপর থেকে তিনি স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এবং কখনও কখনও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকদের অধীনে এর চিকিৎসা শুরু করেন। বাজানদার চিকিৎসার জন্য প্রায় ছয় লাখ টাকা (৬০০০ মার্কিন ডলার) খরচ করে তিনবার ভারতে গেছেন। বাজানদার এর অসুখের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল দেখে কলকাতার কোঠারি মেডিক্যাল সেন্টারের ডাঃ উমেশ কুমার ভোহরা মন্তব্য করেন, হোমিওপ্যাথি ওষুধের ভুল ডোজ এই রোগের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে এবং পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে গেছে

প্রায় ১৫ বছর এমন ভুল চিকিৎসার মধ্য দিয়ে কাটাতে হয়েছে আবুল বাজানদারকে, যখন তার কোন চিকিৎসা হয়নি, বরং পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকে। গাছের শেকড়ের মতো আঁচিল তার হাত ঢেকে ফেলে যার ফলে তিনি আর রিকশা চালাতে পারেন নাফলে তার সকল আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায়স্থানীয় গ্রাম্য ডাক্তার এবং হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকদের কাছ থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা তার অবস্থাকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যায়, চুনকুড়িতে তার খড়ের বাড়ির আঙ্গিনায় বসে স্মৃতি হাতড়িয়ে এসব কথা আওয়ার ভয়েস প্রতিনিধিকে জানান বাজানদার

অস্ত্রোপচারের আগে, বাজানদার খাবার খেতে, পানীয় পান করতে, দাঁত ব্রাশ করতে বা নিজে গোসল করতে পারতেন না। আমি একজন সাধারণ মানুষের মতো বাঁচতে চাই। আমি শুধু আমার মেয়েকে ঠিকভাবে ধরে রাখতে এবং তাকে আলিঙ্গন করতে সক্ষম হতে চাই,” তিনি অপারেশনের আগে গণমাধ্যমের সাথে আলাপকালে এমনভাবে নিজের কষ্ট এবং সাধের কথা বলেছিলেন বাজানদারসফল অস্ত্রোপচারের ফলে তার অবস্থার উন্নতি হয় এবং তিনি নিজের হাতে খেতে এবং লিখতে সক্ষম হনযাহোক, বাজানদার আরও চিকিৎসা এবং অপারেশন চালিয়ে যেতে পারেননি এবং এমনকি আতঙ্ক এবং তীব্র দারিদ্র্যের কারণে মেডিকেল কর্মীদের অবহিত না করেই হাসপাতাল ছেড়ে চলে যান। অবশ্য, কিছুদিন পর তার রোগের অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকলে তিনি নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং সম্প্রতি আবারও ঢাকায় হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করেন

দুই মেয়ের জনক আবুল বাজানদার (৩৫) বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দূরে দাকোপ উপজেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে বাস করেনবাজানদার তার স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে চুনকুড়ি গ্রামের নদীর তীরে একটি খড়ের বাড়িতে থাকেন। তিনি প্রায় দুই দশক ধরে বিরল জেনেটিক রোগ এপিডার্মোডিসপ্লাসিয়া ভেরুসিফর্মিস এ ভুগছেন। প্রাথমিকভাবে তিনি খুলনায় গ্রাম্য চিকিৎসক এবং হোমিওপ্যাথি ডাক্তারদের কাছে চিকিৎসা নেন পরবর্তীতে ভারতের বেশ কয়েকটি শহরেও চিকিৎসা করতে যান, কিন্তু কোনো সাফল্য পাননিস্থানীয় সাংবাদিকরা যখন তার বিরল রোগের সংবাদ প্রকাশ করেন, তখনই প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নির্দেশনায় ঢাকার বিশেষায়িত হাসপাতালে তার চিকিৎসা শুরু হয়

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি (এসএইচএনআইবিপিএস) এর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডাঃ সামন্ত লাল সেনের নেতৃত্বে আবুল বাজানদারের উভয় হাতে একাধিক অপারেশন করেছেন অপারেশনের পরপরই তিনি প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন, "এখন আমি আমার হাত দিয়ে আমার মেয়েকে স্পর্শ করতে পারি, যা আমি আগে কল্পনাও করতে পারিনি"। তবে তার পায়ে এখনো অস্ত্রোপচার করা হয়নি বলে জানিয়েছেন বাজানদারতাই এখনও তিনি তার উভয় পায়ে অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকা শেকড়ের ফলে প্রচণ্ড কষ্টের মধ্যে দিন পার করছেনপরিবারের অন্য কারো সাহায্য ছাড়া তিনি একা একা দাঁড়াতে ও চলতে পারেন না।

২০১৬ সাল থেকে বাজানদারের দেহে ২৫টিরও বেশি অস্ত্রোপচার করা হয়েছে এসময় চিকিৎসকরা তার দেহ থেকে প্রায় ৫ কেজি সবুজ-ধূসর দাগযুক্ত শেকড়গুলি অপসারণ করেছেন বাজানদারের অবস্থা এখন প্রায় ৫০ শতাংশ নিরাময় হয়েছে, তার হাতের ক্ষত প্রায় সেরে গেছে, কিন্তু তার পায়ের আঁচিলগুলোতে এখনও অপারেশন করা হয়নি

বাংলাদেশে স্বাস্থ্য বীমা সুবিধা না থাকায় সকল রোগীর চিকিৎসা, অপারেশন ও ওষুধের খরচ ব্যক্তিগতভাবে বহন করার কথা, যা আবুল বাজানদার, শাহানা খাতুন ও রিপন দাসের মতো দরিদ্র পরিবারের পক্ষে বহন করা একেবারেই অসম্ভব। তাই তাদের চিকিৎসা ও অপারেশন তখনই সম্ভব, যখন সমাজসেবা বিভাগ চিকিৎসা, অপারেশন, ওষুধের খরচ এবং হাসপাতালের শয্যায় কয়েক সপ্তাহ বা কিছু ক্ষেত্রে কয়েক মাস থাকার জন্য হাসপাতালের ফি পরিশোধ করে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের এই আর্থিক সহায়তা সত্ত্বেও, এটি তাদের পরিবারের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং রয়ে গেছে কারণ রোগী কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস ধরে রাজধানী ঢাকার বিশেষায়িত হাসপাতালে একা থাকতে পারেন না। অথচ সমাজসেবা অধিদপ্তর শুধুমাত্র রোগীর ব্যয়ভার বহন করে, রোগীর পরিবারের কিংবা সেবা-শুশ্রুষাকারী ব্যক্তিদের জন্য নয়

আবুল বাজানদারের ক্ষেত্রে, শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারিতে অপারেশনের সময় তার স্ত্রী এবং দুই মেয়েকে দুই মাস হাসপাতালে বা আশেপাশের এলাকায় কাটাতে হয়েছিল, কারণ তাদের ছোট বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্য কোনও বিকল্প ব্যবস্থা ছিল না। এই বাস্তবতায় আবুল বাজানদারকে ঢাকায় থাকার জন্য চারজনের খরচ বহন করতে হয়েছে, অথচ তিনি সরকারের কাছ থেকে মাত্র একজনের জন্য আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন। অধিকন্তু, এই মাসগুলিতে তারা একটি পয়সাও উপার্জন করতে পারেনি, কারণ পুরো পরিবার শুধুমাত্র বাজানদারের চিকিৎসা ও অপারেশন নিয়েই ব্যস্ত ছিলএছাড়াও ছোট শিশুরা স্কুলে পড়াশুনা থেকেও বঞ্চিত হয়েছে, কারণ এই সময়ে তাদের ক্লাস মিস করতে হয়আবুল বাজানদার যেমনটি আওয়ার ভয়েসকে জানালেন, "আমি প্রতিবন্ধী ভাতা হিসেবে বছরে প্রায় ৫০০০ টাকা (৫০ মার্কিন ডলার) পাই। এই টাকা দিয়ে কি ওষুধ কিনবো, আমাদের মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ বহ্ন করবো নাকি আমাদের চারজনের জন্য খাবার কিনবো?"

প্রথম বৃক্ষ-মানবী শাহানা খাতুন

শাহানা খাতুন (১৬) তার মুখে, নাকে সহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে অনেকগুলো আঁচিলের সমস্যায় ভুগছেন। চিকিৎসকরা তার রোগটিকে এপিডার্মোডিসপ্লাসিয়া ভেরুসিফর্মিস বলে অভিহিত করেছেন, যা ট্রি-ম্যান সিনড্রোম নামে পরিচিত। ২০১৮ সালে শাহানার দেহে এই রোগ শনাক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এই রোগটি শুধুমাত্র পুরুষ রোগীদের দেহে দেখা গেছে সেই হিসেবে শাহানাকে এই বিরল রোগে আক্রান্ত বিশ্বের প্রথম মহিলা রোগী হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

শাহানা খাতুন             ছবি - এএইচ/ওভি

রাজধানী ঢাকা থেকে ১৮৫ কিলোমিটার দূরে নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার বালুচোরা গ্রামে শাহানা তার বাবা ও দাদির সঙ্গে থাকেন। শৈশবে মাকে হারিয়েছেন। শাহানার বাবা শাহজাহান একজন কৃষক ও দিনমজুর। পরিবারে তিনিই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি, যার উপর পুরো পরিবার নির্ভরশীল। শাহজাহান আওয়ার ভয়েসকে বলেন, "আমি শাহানার জন্য ওষুধ কিনলে আমরা আমাদের তিন সদস্যের পরিবারের জন্য খাবার কিনতে পারব নাসে কারণে আমরা এই হোমিওপ্যাথি ওষুধটি চালিয়ে যেতে পারিনি, যদিও এটি শাহানার রোগটি অনেকাংশেই ভালো হতে সাহায্য করেছে"

হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক ডাঃ হাফিজুর রহমান, যিনি ঢাকার বিসমিল্লাহ হোমিও হলে প্রায় আট বছর কাজ করেছেন, আওয়ার ভয়েসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, "এটি এক ধরনের বড় আঁচিল, যা একটু শক্ত এবং শুষ্ক। আমি চেষ্টা করেছি। এই রোগের চিকিৎসার জন্য হোমিওপ্যাথির বেশ কয়েকটি পথ্যের সমন্বয় করে সেবন করতে হয়তবে, তারা আমার কাছ থেকে মাত্র দুবার ওষুধ নিয়েছিল এবং কোর্সটি সম্পূর্ণ করেনি। হোমিওপ্যাথিতে সর্বোত্তম ফলাফলের জন্য পুরো কোর্সটি সম্পূর্ণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।"

শাহানা ২০১৮ সালে শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে বিনামূল্যে তার মুখ ও শরীরে দুটি অপারেশন করা হয়েছেতবে, তিনি অপারেশনের জন্য তাকে যখন বেহুঁশ করা হয়, তখন বেশ কয়েকদিন ধরে তার জ্ঞান না ফেরায় তার অভিভাবকরা এটাকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করে এবং সেকারণে তারা সেখানে আর চিকিৎসা চালিয়ে যাননি। চিকিৎসকরা এই অস্ত্রোপচারকে সফল বলে ঘোষণা করলেও তার বাবার বক্তব্য, এরপর তার দেহে আরও বেশি সংখ্যক আঁচিল দেখা গেছে

তীব্র দারিদ্র্যও চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হওয়ার আরেকটি কারণ। আবুল বাজানদারের মতো তিনিও ঢাকায় বিনামূল্যে চিকিৎসা পেয়েছেন এবং শুধুমাত্র রোগীর জন্য সমাজসেবা দপ্তর থেকে আর্থিক সহায়তা পেয়েছেনতবে সেখানে চিকিৎসা ও অপারেশন চালিয়ে গেলে শাহানার সঙ্গে তার দাদি ও বাবাকে একসঙ্গে ঢাকায় থাকতে হয়তখন তার বাবা কাজ করতে পারে না এবং সেখানে তাদের খাবার এবং আবাসনের জন্য একটি পয়সাও উপার্জন করতে পারে নাতাই ঢাকায় বিনামূল্যে চিকিৎসার সুযোগ থাকলেও সেটি গ্রহণ করতে পারছেন না শাহানা

সুস্থ হলে ডাক্তার হতে চায় রিপন

রিপন দাস (১৫) এখন ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জের পিএস উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। ছবি আঁকার প্রতি তার আকর্ষণ রয়েছে। তার দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন একজন ডাক্তার হয়ে সমাজের সেবা করার এবং রোগীদের চিকিৎসা ও নিরাময় করার, কারণ চিকিৎসকরা তাদের নিষ্ঠা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ প্রচেষ্টায় তাকে পুরোপুরি ভাল করে তোলার চেষ্টা করেছেন যাহোক, পরিবারের তীব্র দারিদ্র্য বৃক্ষ-মানব নামে পরিচিত বিরল রোগ এপিডার্মোডিসপ্লাসিয়া ভেরুসিফর্মিস এর সাথে লড়াইয়ে প্রধান হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে রিপনের জন্য   

পেশায় মুচি বাবা মহেন্দ্র দাস প্রথম রিপনের হাতে বৃক্ষ-মানব উপসর্গ লক্ষ্য করেছিলেন, যখন রিপনের বয়স মাত্র তিন মাস। রিপনের চিকিৎসার জন্য তিনি অনেক চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞের কাছে ছোটাছুটি করেছেনতিনি ছেলের চিকিৎসার জন্য প্রায় সমস্ত সম্পদ ব্যয় করেছেন কিন্তু তীব্র আর্থিক সংকটের কারণে চিকিৎসার কোর্সটি সম্পূর্ণ করতে পারেননি।

রিপন দাস      ছবি-এএইচ/ওভি

মহেন্দ্র দাস আওয়ার ভয়েসকে বলেন, “একদিন এই গ্রামে একটি সামাজিক অনুষ্ঠান ছিল, সেখানে এক সাংবাদিকের বন্ধু এসে রিপনের রোগের কথা শুনতে পান তিনি তার ছবি তুলে তার সাংবাদিক বন্ধুর সাথে শেয়ার করেন। এরপর স্থানীয় সাংবাদিক রিপন দাসের রোগ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করলে অনেকেই তার চিকিৎসায় সহায়তা করতে এগিয়ে আসেন এবং আমরা বারডেম জেনারেল হাসপাতাল ও শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও অপারেশন করি। তার হাত ও পায়ের বেশ কয়েকটি সফল অপারেশনের পর বর্তমানে তিনি রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ডাঃ মোঃ ফয়সাল আজমের কাছ থেকে ওষুধ গ্রহণ করেন যার ফলে তার অবস্থার উন্নতি হয়েছে। যাইহোক, প্রায় সাত ধরনের ওষুধের কোর্সে প্রতি মাসে প্রায় দুই হাজার বাংলাদেশী টাকা ( ২০ মার্কিন ডলার) খরচ হয়, যা আমরা শুধুমাত্র কয়েক মাস কিনতে পেরেছি এবং আর্থিক সংকটের কারণে নিয়মিত চালিয়ে যেতে পারিনি।

অন্য দুজন বিরল রোগের রোগীর ক্ষেত্রে এমনটি না ঘটলেও রিপনের হাত-পা কালো হয়ে গেছে এবং মাথার ত্বকেও সংক্রমণ হয়েছে। তিনি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সরকারী ভর্তুকি হিসাবে বছরে মাত্র ৫০০০ টাকা (৫০ মার্কিন ডলার) পান, যেখানে তাকে মাত্র ২/৩ মাসের ওষুধ কিনতেই ৫০০০ টাকা খরচ করতে হয়।

সমান স্বাস্থ্য সুবিধা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য বীমা ব্যবস্থার জন্য তাগিদ

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডার্মাটোলজির সাবেক কনসালটেন্ট ডাঃ মশিউল আলম হোসেন বলেন, “এই রোগীদের প্রাথমিকভাবে ইলেক্ট্রো সার্জারি, ক্রাইও সার্জারি বা লেজার সার্জারি নামে তিনটি পন্থায় চিকিৎসা করা হয়। তবে যখন রোগের অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে যায় এবং তীব্র পর্যায়ে এই রোগীদের বার্ন ইউনিটে স্থানান্তরিত করা হয় এবং প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। বিরল রোগের এই তিনজন রোগী দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করায়, তারা তাদের বিরল জেনেটিক রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে কোন চিকিৎসা সুবিধা সম্পর্কে অবগত ছিলেন না এবং শুধুমাত্র সাংবাদিকরা তাদের তথ্য প্রকাশ করার পরই তারা চিকিৎসা পান।

ডাঃ মশিউল আলম হোসেন      ছবি-এএইচ/ওভি

ডাঃ মশিউল আলম হোসেন মনে করেন, বাংলাদেশের প্রায় ১৮ কোটি মানুষ বাস করে, যাদের জন্য এখন পর্যন্ত কোন স্বাস্থ্য বীমার ব্যবস্থা নেই। এই দরিদ্র মানুষগুলো প্রায়ই সময়মত স্বাস্থ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। এসব বিবেচনায় আমি মনে করি, এই বিরল জেনেটিক রোগের রোগীর সংখ্যা হয়ত আরও অনেক বেশি হতে পারে, যদি আমাদের দেশের সব মানুষের সঠিক স্বাস্থ্য তথ্য ও পরিসংখ্যান থাকে।তিনি সব মানুষের জন্য মৌলিক স্বাস্থ্য বীমা সুবিধার ওপর জোর দেন। বাংলাদেশে এ ধরনের বিরল রোগ মোকাবিলায় চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য সুবিধার সমান সুযোগ নিশ্চিত করার উপরেও গুরুত্ব দেন তিনি

আন্তর্জাতিক সহায়তা এবং সহযোগিতা আহ্বান

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রী ড. সামন্ত লাল সেন জেনেটিক বিরল রোগের এই রোগীদের যথাযথ চিকিৎসা সুবিধা, অপারেশন, সঠিক কাউন্সেলিং, বিনামূল্যে ওষুধ এবং প্রয়োজনে জিন থেরাপি নিশ্চিত করার জন্য অবিলম্বে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য বাংলাদেশি চিকিৎসক এবং আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থা এবং চিকিৎসকদের যৌথ প্রচেষ্টার উপর জোর দিয়েছেন।

ডঃ সেন হাঙ্গেরির দাতব্য সংস্থা 'অ্যাকশন ফর ডিফেন্সলেস পিপল ফাউন্ডেশন'-এর সহযোগিতায় বাংলাদেশি চিকিৎসকদের সফলভাবে জোড়া মাথা নিয়ে জন্ম নেওয়া যমজ সন্তানকে আলাদা করার সাফল্যের কথা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেন এবং এই বিরল রোগীদের জীবন বাঁচাতে সহায়তা এবং দক্ষতার হাত বাড়িয়ে দিতে আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থা এবং স্বাস্থ্য সংস্থাগুলির প্রতি আহ্বান জানান

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow

News Desk Chief Editor, Our Voice Online