বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ে আশার আলো: ঠান্ডা ঝিরি পাড়া স্কুল
আতিকুর রহমান, বাকৃবি
বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার ঠান্ডা ঝিরি পাড়া দুর্গম পাহাড়ের কোলে একসময় যেখানে শিশুরা দিনভর জুম চাষে ব্যস্ত থাকত, সেখানে এখন প্রতিদিন ভেসে আসে বর্ণমালা শেখার গান।
ফিউচার ফ্লেয়ার ফাউন্ডেশন (এফএফএফ) ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি এখানে চালু করেছে তাদের প্রথম প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্র, যেখানে প্রাথমিকভাবে ২০ জন শিক্ষার্থীর মাধ্যমে শুরু হয় যাত্রা। বর্তমানে স্কুলটিতে ১৪ জন ছাত্রছাত্রী নিয়মিত পাঠ গ্রহণ করছে।
স্থানীয়ভাবে একে “ঠান্ডা ঝিরি পাড়া স্কুল” নামেই ডাকা হয়। টিনের ভবনে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটিতে চলছে নিয়মিত পাঠদান কার্যক্রম। স্থানীয় একজন শিক্ষক ফিউচার ফ্লেয়ার ফাউন্ডেশন এর অর্থায়নে ও তত্বাবধানে চালাচ্ছেন এই কার্যক্রম। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ সরবরাহের দায়িত্ব নিয়েছে এফএফএফ। বর্তমানে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করা হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
ফাউন্ডেশনের সভাপতি মো. মাহির দায়ান বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, প্রতিটি শিশুই শিক্ষার অধিকার রাখে। ঠান্ডা ঝিরি পাড়ার বাচ্চারা আগে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ছিল, এখন তারা স্বপ্ন দেখতে শিখছে। এটা আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন।”
সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জয়েতা বিশ্বাস ত্রয়ী জানান, “এই স্কুল শুধু শিক্ষা নয়, বরং আত্মবিশ্বাস আর মানবিক বিকাশের কেন্দ্র হয়ে উঠছে। আমাদের লক্ষ্য একে মানসম্মত শিক্ষা ও এক্সট্রা কারিকুলার কার্যক্রমের সমন্বয়ে এগিয়ে নেওয়া।”
এফএফএফের স্থানীয় প্রতিনিধি অংসাহ্লা মারমা বলেন, স্থানীয় মারমা জনগোষ্ঠীর শিশুরা এই উদ্যোগে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছে। আগে ছোট বয়সে তারা পরিবারের সঙ্গে জুম চাষে চলে যেত, কারণ পড়াশোনার সুযোগ ছিল না। এখন তারা প্রতিদিন বই হাতে স্কুল আসে।
৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থী নমুংসিং মারমার গল্পই যেন এই পরিবর্তনের প্রতীক। আগে প্রতিদিন জুমে গিয়ে কাজ করত সে, কিন্তু এখন স্বপ্ন দেখে—একদিন ঢাকায় গিয়ে বড় হয়ে শিক্ষক হবে। নয়ইয়ের চোখে এই স্কুল শুধু শেখার জায়গা নয়, নতুন জীবনের দরজা।
স্কুলটি রুমা উপজেলা সদর থেকে নদীপথে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরের এক পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। পাহাড়ি পথে প্রায় ২৫ মিনিট হেঁটে পৌঁছাতে হয় স্কুলটিতে। দুর্গম এই অবস্থান সত্ত্বেও ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধি অংসাহ্লা মারমা এবং প্রতিনিধিরা শিক্ষার মান ও উপস্থিতি নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।
অংসাহ্লা মারমা বলেন, স্থানীয় জনগণ স্কুলটিকে তাদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণের প্রতীক হিসেবে দেখছে। তাদের সন্তানদের একসময় শহরে গিয়ে পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ইচ্ছা এখন বাস্তবতার পথে হাঁটছে। যদিও অর্থের জোগান একটি বড় চ্যালেঞ্জ, তবুও ফাউন্ডেশনটি স্কুলের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
ফিউচার ফ্লেয়ার ফাউন্ডেশন বর্তমানে আরও একটি স্কুল পরিচালনা করছে এবং দ্রুতই আরও দুটি ছোট পরিসরের স্কুল চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি শুধু শিক্ষা নয়, বরং শিশুদের মানসিক বিকাশ, স্বাস্থ্যসেবা, সাইকোলজিকাল সাপোর্ট ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মাধ্যমেও কাজ করে যাচ্ছে।
স্কুলটির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ধাপে ধাপে এগিয়ে নেওয়ার। প্রথমে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা, এরপর ধীরে ধীরে এক্সট্রা কারিকুলার কার্যক্রম ও সৃজনশীল প্রশিক্ষণ যুক্ত করা হবে। পাশাপাশি ফাউন্ডেশনটি টেকসই ফান্ড গঠন এবং দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন সংস্থা ও দাতাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে।
What's Your Reaction?

