পরিত্যক্ত ‘আল্পনা’ হল নিয়ে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা!

ফরহাদ খান, নড়াইল
নড়াইলের কালিয়া উপজেলা শহরে পরিত্যক্ত ‘আল্পনা’ সিনেমা হল ভবন নিয়ে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে!
দীর্ঘ ২০ বছর ধরে পরিত্যক্ত ভবনটিতে ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ‘কালিয়া উপজেলা তাবলিগী মার্কাজ মসজিদ’ হিসেবে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। টিনশেডের ইটের দেওয়াল ঘেরা ভবনটিতে প্রায় ২০ বছর আগে সিনেমা হলের কার্যক্রম শেষ হয়েছে। এতো বছর ধরে পরিত্যক্ত ছিল ভবনটি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কালিয়ায় পরিত্যক্ত ‘আল্পনা’ সিনেমা হল ভবনে ২২ সেপ্টেম্বর মার্কাজ মসজিদের ব্যানার টানানো হয়েছে। নামকরণ হয়েছে, ‘কালিয়া উপজেলা তাবলিগী মার্কাজ মসজিদ’। এ নিয়ে একটি মহল জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াতে উঠেপড়ে লেগেছে বলে জানা গেছে। এরই অংশ হিসেবে কয়েকটি গণমাধ্যমে ভুল তথ্য দিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ২৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি অনলাইন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ওই অনলাইনটি শিরোনাম করেছে, ‘আল্পনা’ সিনেমা হল এখন ‘তাবলিগী মার্কাজ মসজিদ’। এই অনলাইনে একজন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের বক্তব্য ছাপা হয়েছে। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, “অবশ্যই মসজিদ হতে হবে। তবে অধুনালুপ্ত সিনেমা হলে না করলে ভালো হত। তাই বিষয়টি দুঃখজনক। কাছাকাছি তৈরি হচ্ছে সরকারের আধুনিক মডেল মসজিদ। ফলে এই জায়গাটি সংরক্ষণ করা যেত।”
ওই খবরে আব্দুল মোতালেব নামে আরেকজনের বক্তব্যে বলা হয়েছে, “আরও অনেক জায়গা ছিল, সেখানে তাবলিগী মার্কাজ মসজিদ করলে ভালো হত।”
এই খবরের সূত্র ধরে কয়েকটি গণমাধ্যমে বিভিন্ন চটকদার শিরোনামে খবর প্রকাশ করে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে আব্দুর রহমান নামে এক ব্যক্তি বলেন, কালিয়ার আল্পনা সিনেমা হলটি দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। এখন সিনেমা হলে কেউ ছবি দেখতে আসেন না। তাই সিনেমা হল নতুন করে চালু করলেও দর্শক পাওয়া যাবে না। যে কারণে প্রায় ১০ থেকে ১৫ বছর ধরে নড়াইল শহরের চিত্রাবাণী ও সীমাখালী এলাকার একটি সিনেমা হল এবং লোহাগড়া উপজেলার সন্ধ্যা ও সেভেন স্টার সিনেমা হল বন্ধ রয়েছে। কালিয়ার আল্পনা সিনেমা হলের অবস্থা একই রকম।
ফোরকান আহমেদ, আব্দুল্লাহ শেখ, জহির উদ্দিন, আকবার মোল্যা, শিক্ষার্থী হালিমা খাতুন, জাইমা ইসলামসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ বলেন, নড়াইলের সব সিনেমা হল বন্ধ রয়েছে ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে। সেইসব হল ভেঙ্গে মালিকপক্ষ মার্কেট করেছেন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করেছেন। কেউ ভাড়া নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করেছেন। তাতে কোন সমস্যা হয়নি। হঠাৎ করে কালিয়ার আল্পনা সিনেমা হলটিতে মসজিদ করায় কিছু গণমাধ্যম উঠেপড়ে লেগেছে। কেন মসজিদ করা হলো? অথচ এটি তো দীর্ঘ ২০ বছর পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। এখানে কেউ না কেউ কিছু করবেন, এটাই স্বাভাবিক।
তারা আরো বলেন, বিষয়টি এমন নয় যে, চালু অবস্থায় আল্পনা সিনেমা হলটি জোরপূর্বক দখল করে মসজিদ করা হয়েছে। এটি যদি মসজিদ ব্যতীত কেউ অন্য কিছু করতেন, তাও গ্রহণযোগ্য হতো। যেমন, নড়াইলের আরো চারটি সিনেমা হল বিলুপ্ত হয়ে মার্কেট, ব্যবসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এ অবস্থা শুধু নড়াইলে নয়, সারাদেশেই সিনেমা হলের একই চিত্র। দেশের বেশির ভাগ সিনেমা হল অচল হয়ে পড়েছে। কারণ প্রযুক্তির যুগে সবার হাতে হাতেই যেন সিনেমা হল রয়েছে। তাই সময় ও বাড়তি টাকা খরচ করে কেউ আর সিনেমা দেখতে চান না। যে কারণে পরিচালকরা পর্যন্ত সিনেমা, নাটকসহ বিনোদন কেন্দ্রীয় বিষয়গুলো ইউটিউব ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুভমুক্তি দিচ্ছেন। তাই পরিত্যক্ত সিনেমা ভবনে মসজিদের কার্যক্রম শুরু নিয়ে এতো হৈচৈ করার কিছু নেই। এটা নিছক কিছু গণমাধ্যমের অপকৌশল মাত্র। দেশের ভাবমূর্তি ক্ষূণ্ণ করার অপচেষ্টা ছাড়া কিছুই নয়। এ ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। এই চক্রান্ত সাধারণ জনগণ এবং কোনো রাজনৈতিক দলসহ ধর্মপ্রাণ মানুষ মেনে নেবে না। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে দায়িত্বশীল হতে হবে। একটি গণমাধ্যমের বিভ্রান্তিমূলক খবর দেখে অন্য গণমাধ্যমের ‘হুমড়ি খেয়ে পড়া’র অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাহলে গণমাধ্যমের প্রতি গণমানুষের আস্থা অটুট থাকবে।
এ ব্যাপারে নড়াইলের কালিয়া উপজেলা ওলামা ও ইমাম পরিষদের সভাপতি মাওলানা হাফিজুর রহমান বলেন, ‘এখানে আমরা তাবলিগি মার্কাজ মসজিদ চালু করেছি। বিভিন্ন দেশসহ ঢাকার কাকরাইল থেকে কালিয়ায় যে তাবলিগের জামাত আসবে, তারা প্রথমে এখানে আসবেন। পরে স্থানীয় তাবলিগ জামাতের সাথীদের সঙ্গে পরামর্শ করে বিভিন্ন মসজিদে যাবেন। এই কাজের জন্য পরিত্যক্ত ভবনটি আমরা ইজারা নিয়েছি।
কালিয়া উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৪ সালে ‘টাউন হল’ নামে ভবনটির উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক শাফায়াত আলী। কয়েক বছর পর ভবনটি ইজারা নিয়ে ‘আল্পনা’ নামের একটি সিনেমা হল চালু করা হয়। প্রায় ২০ বছর আগে সেই সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেলে ভবনটির আর ব্যবহার হয়নি। দীর্ঘবছর পরিত্যক্ত থাকায় ভুতুড়ে পরিবেশসহ মাদকসেবীদের নিরাপদ জায়গা হয়েছিল। এতে উপজেলা শহরের প্রাণকেন্দ্রের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছিল।
এ বিষয়ে কালিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাশেদুজ্জামান বলেন, ভেস্টেড প্রোপার্টি (অর্পিত সম্পত্তি) হিসেবে ভবনটি ইজারা দেওয়া হয়। এক সময় সিনেমা হল কর্তৃপক্ষ ইজারা নিয়েছিল। সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর গত ২০ বছর এটি ইজারা হয়নি। এতে জায়গাটি মাদকসেবীদের আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। এ জন্য সরকারি সম্পত্তি দখলে রাখা ও রাজস্ব আদায়ের জন্য ভবনটি ইজারা দেওয়া হয়েছে।
What's Your Reaction?






