মহান শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলী
- সিরাতুন নাইম
F... L... Y, Fly. Fly মানে মশা। আমার সাথে সাথে আমার ছাত্রী ও বলছে, F... L... Y... Fly, Fly মানে মশা। ছাত্রীর বাবা পাশ থেকে বলছেন, সিরাত, ভুল হল, দেখে ঠিক করে নাও। চট করে বই এর দিকে তাকালাম। মেজাজ খারাপ হল। fly বানান ভুল হওয়ার কি আছে। ঠিকই তো আছে। পণ্ডিত আসছেন, অতীশ দীপঙ্কর। আমার ভুল ধরে! মনে মনে একশ’টা বকা দিয়ে আবার পড়ানোয় মনোযোগ দিলাম।
অগ্নি, বলো, F.l.y... Fly, Fly মানে মশা। আমার বাধ্য ছাত্রী আমার সাথে সাথে বলল। এবার ছাত্রীর বাবা মেয়ে কে বললেন, মা বলো, Fly মানে মাছি।
আমার তো মাথায় হাত। মশা মাছি কেমনে যে এক হয়ে গেল! কি যে লজ্জা। আমার লজ্জা আরও বাড়িয়ে দিয়ে ছাত্রী বলল, Fly মানে মশা। বাবা, তুমি কি মিস এর চেয়ে বেশি জান, মিস কি কখনো ভুল করতে পারে! আমার পুচকে ছাত্রীর কাছ থেকে শিখলাম, শিক্ষকরা কখনই ভুল হতে পারেন না। কখনই না। এবং আমার ছাত্রীর বাবা ছিলেন আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ডাঃ ইয়াসিন।
স্যার, আপনি ঠিক ছিলেন, আপনারা কখনোই ভুল হতে পারেন না। এই দূর্বিনীত ছাত্রীকে ক্ষমা করবেন। শ্রদ্ধা জানবেন!
আমাকে এমন অকুণ্ঠ বিশ্বাস করতেন আরও একজন, আলম স্যার। রেজাউল করিম আলম। আমার এসএসসি পরীক্ষার সময়। টেস্ট পরীক্ষার পর আমার ক্লাস টিচার আমার হাতে অংক খাতা ধরিয়ে বললেন, তোমার কি মনে হয় তোমার ফাইনাল পরীক্ষা দেয়া উচিত! শিক্ষকের কথা কি শুনব, আমি আমার খাতা দেখে মুগ্ধ। ঐকিক নিয়মের দুইটা অংক ছিল, দুইটাই করেছিলাম, দুইটাই হইছে, ১৪ পাইছি। মুগ্ধতা কাটলে বাস্তবতায় ফিরে বুঝলাম, ১০০ তে ১৪ পেলে সত্যিই আমাকে পরীক্ষা দিতে যেতে দিবে না।
ক্লাস শেষ হতেই ছুটে গেলাম আলম স্যার এর কাছে। খাতা দেখে স্যারও আমার মতো মহাখুশি। সবাই ১০টা অংক করে ৭/৮টা ঠিক হয়, তুমি ২টা করে ২টাই হয়েছে! তোমার মতো মাথাওয়ালা ছাত্রী আমি খুব একটা দেখি নাই আম্মা! কিন্তু মা এই মার্ক নিয়ে তো স্কুল থেকে পরীক্ষা দিতে দিবে না। যদি দিতে দেই আর তুমি যদি ফাইনালেও এমন মার্ক পাও তাহলে তো মা, সাড়ে সর্বনাশ। আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তো মাঠে মারা যাবে।
আমাকে নিয়ে উনার পরিকল্পনার শেষ ছিল না। হায়ার সেকেন্ডারীর পর ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ব, কবিতা লিখব, থিয়েটার করব, এত ভালো অভিনয় শিল্পী হবো যে, রবীন্দ্রসদন, আরণ্যক, বা নাগরিক এ আমাকে নিয়ে হুড়োহুড়ি পড়ে যাবে। সেলিম আল দীন, নুরুল মোমেন, সারা জাকের, আলি জাকের, আসাদুজ্জামান নূর, শম্ভু মিত্র, শিশির কুমার ভাদুড়ীকে লোকে ভুলে যাবে আমাকে মনে রাখতে গিয়ে। এখন মাধ্যমিকই যদি পার হতে না পারি তাহলে তো সত্যিই সাড়ে সর্বনাশ। আমাদের দু’জনের চিন্তা, কিভাবে অংকে পাশ করা যায়। এরপর উনি আমাকে নিয়ে গেলেন ব্রজেন স্যার এর কাছে।
ব্রজেন স্যার বছর খানেক হলো আমাদের স্কুলে জয়েন করেছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অংকে মাস্টার্স করেছেন। আলম স্যার গিয়ে বললেন, দেখো তো ব্রজেন, আমার মেয়েটাকে কেমন করে পাশ করানো যায়। স্যার আগে আমাদের ক্লাস নিয়েছেন, আমার অংকে পারদর্শীতার কথা জানেন। মুখ কাচুমাচু করে বললেন কাজটা অন্য কাউকে দিলে হয় না? আলম স্যার বললেন, তোমার মতো ইয়াং, এনার্জেটিক শিক্ষক যদি এ কথা বলে তাহলে তো ছাত্র- ছাত্রীরা ফেল করবেই। শেষ পর্যন্ত ব্রজেন স্যারকেই দায়িত্ব নিতে হয়েছিল।
এরপর শুরু হলো অংক নিয়ে কসরত। স্যার আমাকে যেই অংক দেন, আমি গুণ করে ভাগ করে ফেলি, সহজ অংক, ঐকিক নিয়ম! আমাকে ঐকিক নিয়মের বাইরে আনতে স্যার কে অনেক মেহনত করতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আমি স্কুল ফাইনাল পাশ করি, হ্যাঁ, অংকে সর্বনিম্ন গ্রেড পেয়েছিলাম, বি গ্রেড। কিন্তু যে স্যার, ৩ মাসে কোন ছাত্র-ছাত্রীকে ১০ থেকে ৫০ এর ঘরে পৌছে দেন, তিনি ম্যাজিক জানেন, পড়ানোর ম্যাজিক।
যাই হোক, আলম স্যারের কথাই আসি। উনি গতানুগতিক নিয়মের বাইরে পড়াতেন। উনার কাছে প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রী সম্ভাবনাময় ছিল এবং প্রত্যেককেই উনি আলাদা করে গুরুত্ব দিতেন। উনাকে কখনো দেখিনি বেত হাতে ক্লাসে যেতে। তখন বেত হাতে ক্লাসে যাওয়া ছিল কালচার। মনে করা হতো, না মারলে ছাত্র ছাত্রীরা পড়া করবে না, মানুষ হবে না। উনি কখনোই আমাদের মারেননি অথচ উনাকে কি ভীষন ভয়ই না পেতাম। বলতেন, a guilty mind is always suspicious. তোমরা পড়া না করলে মুখ দেখে আমি ঠিকই টের পাব, তারপর দেবো ভয়াবহ শাস্তি। সেই ভয়াবহ শাস্তি কাউকেই পেতে দেখিনি কখনো।
বলা হয়নি, স্যার ছিলেন ইংরেজির শিক্ষক। উনি খুব মজা করে পড়াতেন এবং ভাবতেন আমরাও বুঝি খুব পড়তে মজা পাচ্ছি। কিন্তু সত্যি কি তাই, কোন ছাত্র-ছাত্রীর কি কখনই পড়তে ভালো লাগে, আমার অন্তত লাগত না।
এবার একটা মজার ব্যাপার বলি। তখন আমি ঢাকায়, দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি, টুইশনি খুঁজছি। স্যার একদিন ফোন করে বললেন, আম্মু, আমার ভাগ্নে আর ওর বন্ধুরা মিলে একটা কোচিং সেন্টারে পড়ায়, আমি ওকে বলেছি, তুমি ওখানে ইংরেজি পড়াবে।
একদিন ভাইয়া আমার ক্যাম্পাসে আসলে, আমরা কথা বললাম, তারপর যে উনি গেলেন আর ফেরেননি। কয় মিনিটে বুঝে গেছেন, আমি পড়ালে কোচিং বন্ধ হতে বেশী দিন লাগবে না!
স্যারের কি আক্ষেপ! উনি কিছুতেই মানতে পারছেন না যে আমার ইংরেজি এতো খারাপ। আজ একটা সত্যি কথা বলি, স্যার, আমি সত্যিই ইংরেজিতে খারাপ, শুধু ইংরেজি বা অংক নয়, আমার পড়াশুনাই ভাল লাগে না, আর যে কাজ ভাল লাগে না সেই কাজ কি ভালো হয় বলেন! শুধু আপনি কষ্ট পাবেন বলে বলতে পারিনি!
আর একটা ঘটনা বলি। তখন ক্লাস এইটে পড়ি। একদিন স্যার-এর কাছে জানতে চাইলাম f….. the time মানে কি! উনি কি চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। বলেছিলেন, সময়কে স্থির করে দাও।
আমি অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলাম, সময়কে থামানো যাই বুঝি? স্যার বললেন - যায়, যদি কেউ চেষ্টা করে। ধরো, তুমি অনেক ভালো ভালো কাজ করলে, মসজিদ বানালে, ইস্কুল বানালে, গাছ লাগালে, মানুষের সেবা করলে, সময়ের চেয়ে তোমার কাজগুলো এগিয়ে গেলো, সময় তোমার কাছে হেরে গেল, থেমে গেল। এবার বল কোথায় শুনেছ এটা, বললাম, অর্ক কথাটা বলেছিল বলে অনিমেষ ওকে থাপ্পড় দিয়েছিল, কালপুরুষ বইয়ে। কী এমন কথা যে ওকে মার খেতে হলো, ডিকশনারিতে খুঁজে পাইনি, তাই আপনাকে বললাম। জানতে চাইলেন বইটা কোথায় পেয়েছি। বললাম - বলতে পারব না। ওয়াদা করেছি। কোথায় পেয়েছি বললে তো আর বই পাব না, সোর্স বন্ধ হয়ে যাবে।
আর কিছু জানতে চাইলেন না স্যার, কিন্তু তারপর যেখানে যতো বই পেয়েছেন আমার জন্য নিয়ে এসেছেন। আমি তো মহা খুশি আর আমার মা মহা বেজার। মেয়ে এমনিতেই পড়ে না, তারপর যেটুকু পড়ে সেটুকু গল্পের বই। মানুষের ছেলে মেয়ে ফার্স্ট সেকেন্ড হয়, শুনতে কতো ভালো লাগে, এই মেয়ে ফার্স্ট সেকেন্ড তো দুরের কথা, ১০ এর মধ্যেই থাকে না। একদিন স্যারকে বললেন, এরকম করে পড়লে তো মেয়ে ফেল করবে, মানুষের কাছে মুখ দেখাতে পারব না। স্যার বললেন, ভাবী, চিন্তা করেন না, ফেলটুস ছাত্র-ছাত্রীরাই জীবনে ভালো কিছু করে, বড় বড় মানুষরা কেউই পড়াশুনোয় ভালো ছিল না, আপনি একদম ভাববেন না।
যায় হোক, এখন আমি f.... the time মানে জানি, ভাবি, একজন মানুষ ভিতর থেকে কতখানি ইতিবাচক হলে এমনভাবে শব্দের মানে বদলে দিতে পারে।
শিক্ষকদের সেকেন্ড পেরেন্টস বলা হয়, আমার ক্ষেত্রে আলম স্যার আমার ফার্স্ট পেরেন্ট। আমার বাবা-মা আমাকে জন্ম দিয়েছেন, আর স্যার আমাকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করেছেন। পিতৃত্ব বা মাতৃত্ব শুধুমাত্র জৈবিক ব্যাপার নয়, আরও বেশি কিছু, গভীর কিছু। পৃথিবীর শুদ্ধতম অনূভুতি!
Living together or flat share!
- মানুষ জ্বিহ্বা দিয়ে, মানুষ খুন করতে পারে জানিস?
- হয়তো পারে কিন্তু আমাকে কেন বলছিস?
- তুই এক্ষুনি যেভাবে কাকির সাথে কথা বললি, বুঝতে পেরেছিস কি যে কতটা রুঢ়ভাবে বললি। একবারও কি ভাবলি উনি কতোটা কষ্ট পেলেন! মা বলেই হয়তো এটা মনে রাখবে না, কিন্তু অন্যরা? এটা উচিত নয়, এরকম আর বলিস না, প্লিজ। এরকম কত যে উচিত অনুচিত শিখিয়েছে তার কোন ইয়াত্তা নেই। বলছি আমার বন্ধু উত্তম কুমারের কথা। যদিও ও আমার ছোট কিন্তু আমরা খুব ভালো বন্ধু।
শুধু তাই নই, এই যে আমি এখন ইংরেজিতে সবার সাথে কথা বলতে পারি সেটার হাতেখড়ি ও উত্তমের কাছে। এখনো আমি বুঝি না যে, দুজন মানুষ এক সাথে থাকলে living together না বলে flat share বলতে হবে কেন! তবুও কেউ যদি বুঝতে চাই তাহলে তার সাথে ইংরেজিতে কথা বলতে পারি ।
এই পড়া নিয়েও যে ওর সাথে কত ঝামেলা করেছি! হয়তো ও আমাকে কোন পড়ার কাজ দিয়েছে, বা কোন আর্টিকেল পড়তে বলেছে, আমিও পড়েছি যতখানি আমার পক্ষে পড়া সম্ভব। তারপর যখন পড়া দিতে গেছি, শুরু করেছে ভুল ধরা। আমার গেছে মেজাজ খারাপ হয়ে, যাহ্, তোর কাছে আর পড়বই না। একবারও মনে হত না যে আসলেই আমার ভুল হচ্ছে। এবং ও যখন বেশি বোঝানোর চেষ্টা করত, যে পড়তে হবে, না পড়লে কেমনে হবে, ইংরেজি শেখা কত জরুরি, তখন তার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিতাম। আর ও যাতে যোগাযোগ করতে না পারে সে ব্যবস্থাও করতাম। তারপর যখন উপলব্ধি করতাম যে, আমার পড়া উচিত তখন আবার ওকে নক করতাম। ও সব ভুলে আমাকে পড়াত।
এরকম ধৈর্যশীল শিক্ষক আমি আর দেখিনি। শুধু আমার বন্ধু বলে যে আমাকেই পড়তে সাহায্য করত তা নয়, ও সবার ক্ষেত্রেই এরকম ছিল। হয়তো ও নিজে কিছু জানে, যেটা জানলে অন্যেরও উপকার হবে সেটা তাদের জানানো ওর নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ত। ওকে দেখে বুঝতাম, শিক্ষক হওয়ার জন্য স্কুল, কলেজ বা ভার্সিটিতে পড়ানোর দরকার নেই, দরকার নেই চক, ডাস্টার বা ব্লাকবোর্ডের, দরকার শুধু মানুষকে ভালো কথা বা ভাল জিনিস জানানোর ইচ্ছে। যেটা ওর আছে। My best teacher forever!
What's Your Reaction?