নতুন উপাচার্যের নেতৃত্বে উন্নয়নের প্রত্যাশা পবিপ্রবি শিক্ষার্থীদের
জান্নাতীন নাঈম জীবন, পবিপ্রবি প্রতিনিধি
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পবিপ্রবি) বরিশাল ক্যাম্পাস, যেখানে অবহেলা, অনিয়মে জর্জরিত সাধারণ শিক্ষার্থীরা। শ্রেণীকক্ষ থেকে আবাসিক হল, সর্বত্র একই চিত্র।
দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানিয়ে পেয়েছে শুধু আশ্বাসের বাণী, কার্যকর কিছু নয়। জুলাইয়ে ছাত্র জনতার আন্দোলনে পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বের প্রশাসনেরও পতন ঘটে। সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় নতুন উপাচার্যের আগমনে শিক্ষার্থীদের মাঝে নতুন করে আশার আলো দেখা দিয়েছে। তাদের দাবি, দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাদের সকল সমস্যার সমাধান।
শ্রেণীকক্ষ: জীর্ণ-শীর্ণ শ্রেণিকক্ষে পাঠ্য কার্যক্রম চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের এনিমেল সায়েন্স অ্যান্ড ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদে। বহিস্থ ক্যাম্পাস হওয়ায় প্রায় সকল ক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার হয় এই অনুষদটি। অনুষদটির দুটি অ্যাকাডেমিক ভবন থাকলেও নেই পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ। এছাড়াও শ্রেণিকক্ষের হোয়াইট বোর্ড থেকে শুরু করে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর সবগুলোরই বেহাল দশা। আবার সাউন্ড সিস্টেম না থাকার কারণে ক্লাস লেকচার স্পষ্টভাবে শুনতে সমস্যা হয় শিক্ষার্থীদের। ক্লাসরুম গুলোতে নেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থা, ফলে গ্রীষ্মকালের অসহনীয় গরমে ক্লাস করতে বেগ পেতে হয় শিক্ষার্থীদের।
অন্যদিকে বৈজ্ঞানিক ল্যাবগুলোর অবস্থাও সন্তোষজনক নয়। নেই পর্যাপ্ত সরঞ্জামাদি, নেই পর্যাপ্ত আসন ব্যবস্থা। যেখানে এই অনুষদের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া পুরটাই নির্ভর করে ব্যবহারিক শিক্ষার উপর, সেখানে ল্যাবগুলোর এমন দশা শিক্ষার্থীদের কাছে কখনই গ্রহণযোগ্য নয়।
স্বাস্থ্য কেন্দ্র: পবিপ্রবির বরিশাল ক্যাম্পাসে স্বাস্থ্যসেবা সংকট নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে চরম উদ্বেগ বিরাজ করছে। ক্যাম্পাসে একটি নামমাত্র হেলথ কেয়ার সেন্টার থাকলেও, সেটি কার্যত অকার্যকর। প্রায় ৫০০-৬০০ শিক্ষার্থীর এই ক্যাম্পাসে নেই কোন প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জামাদি। হঠাৎ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে, কোন প্রাথমিক চিকিৎসা ছাড়াই ঘণ্টাখানেকের পথ পাড়ি দিয়ে ছুটতে হয় শহরে, যা মুমূর্ষু রোগীর জন্যে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
এই বিষয়ে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী বলেন, "অসুস্থ বন্ধুকে নিয়ে রাতের বেলা মাইক্রোবাসে করে হাসপাতালে যাওয়ার সময় খিঁচুনি উঠে যাওয়া বন্ধুর হাতের মুঠ সোজা করতে করতে মৃত্যুর সাথে লড়াই করাটা খুব কাছ থেকে দেখে এসেছি। আমার বন্ধুর শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু আমি তাকে একটুখানি অক্সিজেনের ব্যবস্থা করে দিতে পারিনি। অসহায় আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলাম তার মুখের দিকে। মনে হচ্ছিল আটকে গেছি কোন এক মৃত্যুকূপে।"
আবাসিক হল: এই ক্যাম্পাসে শতভাগ আবাসন ব্যবস্থা থাকলেও, নেই পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা। নেই রিডিং রুম, ইনডোর গেমস, এমনকি সুপেয় পানির ব্যবস্থা। যা শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত কষ্টসাধ্য এবং বিব্রতকর। ছাত্রাবাসে রিডিং রুম না থাকায় শিক্ষার্থীরা অ্যাকাডেমিক ভবনে পড়তে যেতে বাধ্য হচ্ছেন, যা আবার দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় সম্ভব নয়। বিদ্যুৎ চলে গেলে জেনারেটর না থাকায় শিক্ষার্থীরা পড়ে ভোগান্তিতে। এছাড়াও ক্যাম্পাসে ফ্রি ইন্টারনেট সুবিধা থেকেও বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা।
অন্যদিকে পুরাতন আবাসিক ভবনগুলোর বিভিন্ন জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে, পিলারগুলো থেকে হঠাৎ হঠাৎ ভেঙে পড়ে প্লাস্টার। এমন ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে বসবাস করছে শতশত শিক্ষার্থী। আবার পরিচ্ছন্ন কর্মীদের দায়িত্বে অবহেলা এবং পর্যাপ্ত পর্যবেক্ষণের অভাবে ওয়াশরুম ও করিডোরে নোংরা ও দুর্গন্ধে টিকে থাকা দায় । এছাড়া মেধার বিকাশ ঘটাতে ইনডোর গেমসের ব্যবস্থা এবং হলের পক্ষ থেকে বিভিন্ন টুর্নামেন্ট আয়োজন করার দাবি শিক্ষার্থীদের।
অডিটোরিয়াম: ক্যাম্পাসের পুরাতন ও অনাধুনিক অডিটোরিয়ামের সংস্কার চায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তাদের অভিযোগ, একটি মানসম্পন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, বসার ভালো ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত আলো, সাউন্ড সিস্টেম এবং মানসম্মত ডেকোরেশনের অভাব রয়েছে। পুরাতন এই অডিটোরিয়ামের ছাদে ফাটল, দেয়ালে শেওলা এবং রং চটকানো অবস্থা যা দেখতে একটি ভূতুড়ে ঘরের মতো মনে হয়। অনুষ্ঠান চলাকালীন বিদ্যুৎ চলে গেলে, জেনারেটরের অভাবে অন্ধকারে অপেক্ষা করতে হয় বিদ্যুৎ ফিরে আসা পর্যন্ত।
লাইব্রেরি: লাইব্রেরি থাকলেও সেখানে পর্যাপ্ত বইয়ের অভাব। চেয়ার টেবিলের ঘাটতির কারণে শিক্ষার্থীরা পড়ার সুযোগ পায় না।এসবের বাইরে ক্যাম্পাসে নেই কোন ক্যাফেটেরিয়া, টিএসসি এবং মান সম্মত জিমনেশিয়াম। শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশের নেই কোনো সুযোগ।
এই বিষয়ে ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিন ডিসিপ্লিনের ১৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী যায়েদ আহমদ বলেন, “আমাদের হলগুলোর অবস্থা সত্যিই করুণ। বসবাসের যোগ্য কোন হল নেই। অসুস্থ হলে চিকিৎসার জন্য কোন ডাক্তার নেই, এমনকি অ্যাম্বুলেন্সও নেই। আমাদের হলে ইনডোর গেমসের কোন সুযোগ নেই, পর্যাপ্ত চেয়ার-টেবিলও নেই। ঝড়বৃষ্টির সময় কারেন্ট চলে গেলে বিকল্প জেনারেটরও নেই। মূল ক্যাম্পাস থেকে দূরে হওয়ায় প্রশাসনিক বিভিন্ন কাজে বারবার যাতায়াত করতে গিয়ে আমাদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ক্লাসরুমে মাল্টিমিডিয়া নেই, পর্যাপ্ত বেঞ্চও নেই।“তিনি আরও বলেন, “নবনিযুক্ত উপাচার্যের কাছে আমাদের দাবি, ক্যাম্পাসে লেজুড় ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হোক। শিক্ষক ও স্টাফ কর্তৃক শিক্ষার্থীদের নিপীড়ন বন্ধ হোক। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন করতে হবে এবং সকল ধরনের আর্থিক লেনদেনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।“
একই অনুষদের ১৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মরিয়ম নেছা বর্না বলেন, “আমাদের এই ক্যাম্পাসটা ছোট হলেও, একটা অনুষদের জন্য যথেষ্ট। শুধু এই জায়গাটার সদ্ব্যবহার করা দরকার। সুন্দর করে সাজানো হলে এই ক্যাম্পাসটাই হবে শিক্ষার্থীদের স্বপ্নের আবাস”
ছাত্র-শিক্ষক মতবিনিময় এক সভায় নবনিযুক্ত উপাচার্য প্রফেসর ডা. কাজী রফিকুল ইসলাম বলেন, “গত জুনের আগে করা বাজেটে এই ক্যাম্পাসের উন্নয়নের জন্য এক টাকাও বরাদ্দ হয়নি। এর মূল কারণ, এই ক্যাম্পাসের শিক্ষকরা উন্নয়নের জন্য কোনো ডিপিপি (ডেভেলপমেন্ট প্রোজেক্ট প্রোপোজাল) পাঠাননি। তাই, পরবর্তী বাজেটের আগে এখানে বড় কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা সম্ভব নয়। তবে ছোট ছোট সকল সমস্যা সমাধানের জন্য আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। আমি একটি কমিটি গঠন করার প্রস্তাব করছি যা ছাত্রদের বিরুদ্ধে হওয়া সব ধরনের বৈষম্য তদন্ত করবে।“
এছাড়া দুই ক্যাম্পাসকে একীভূতকরণের দাবির বিষয়ে উপাচার্যকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, "এটা রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত, আমরা তোমাদের সাথে একমত পোষণ করলেও রাষ্ট্র যদি চায় তাহলেই কেবল সম্ভব। আর এখানের ভবনগুলোতে কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। এ অবস্থায় আমরা এই ক্যাম্পাসকে আরো সুন্দর এবং আরো উন্নত করতে চাই।“
What's Your Reaction?